কবিতায় এগুলো ভাবতে বাধ্য করে।
কখনো বেদনা, আবার কখনো আসে রোমান্টিকতা।
পড়ুন মনোযোগ সহকারে —
——
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
——-
একটু ভাবুন—
বনলতা সেন কে?
নাটোর অর্থ কি?
হাজার বছর ধরে—-!
উপমা গুলোর গভীরতা —!
বনলতা সেন কবিতাটির শুরু ও শেষ, দুই দিকেই অসীম। বেদনাও অসীম। মানব গভীরতাও অসীম। প্রেমও চলমান—। ট্রাজেডিও অসীম অমাপ্ত।
একটি সীমিত কবিতা এর চেয়ে গভীর ও অসীম হতে পারে না। বনলতা সেন কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের গভীর ও রোমান্টিক কবিতা। নিজের সেরা কবিতা তো বটেই।
অনেক আলোচক বা সমালোচক বলেছেন এডগার এলেন পো’র “টু হেলেন” কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বনলতা সেন কবিতা টি লিখেছেন। আমি তা মনে করি না। এটা বঙ্গ থেকে মহা চিন্তার ফসল। এখানে উপমহাদেশের ভাব স্পষ্ট। বঙ্গের নাটোরকে দিয়ে বহুদূরে, অচেনা, দূর্গম ও বহুরূপ বুঝিয়েছে। উপমায় এনেছেন বাংলার প্রাচীন রাজা বিম্বিসার ও অশোকের নাম। ভারতবর্ষের দক্ষিণ দ্বীপ সিংহল। সেন শব্দটিও বাংলার রাজাদের উপাধি। মালয় তাও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ। উপাদান বাংলা কিংবা উপমহাদেশীয় হলেও চিন্তা মানব ইতিহাসের সমান। ভাবনা পৃথিবীর সমান। ভ্রমণ পৃথিবী জুড়ে।
কথা স্পষ্ট।সহজও বটে, কবিতাটি ভারতের মহা চিন্তার বাহিরে যেতেই পারে না।
এডগার এলেন পো’র নাম এনে যারা কবিতাটিতে আরেকটি মহাদেশের ভাগ বসাতে চাচ্ছে তারা বাংলার অন্যতম সেরা কবির উপর অবিচার করছে নিজেদের সংকীর্ণতা থেকে।
বনলতা সেন কাব্য গ্রন্থটি জীবনানন্দ দাশের সেরা কাব্যগ্রন্থ। পড়লেই বুঝা সম্ভব নয়। শিক্ষা, পরিশ্রম ও চেষ্টা দরকার এটি বুঝবার জন্য।
এই কাব্যগ্রন্থে জীবন, প্রেম ও অদৃশ্য একসাথে বাস করে। ৩০টি কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থে। এটি জীবনানন্দের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
মূল্য ছিল ২টাকা। ১৯৫২ সালের কথা।
বনলতা সেন, পথ হাঁটা, সুচেতনা, সবিতা, সুরঞ্জনা, অবশেষে, কমলালেবু, আমি যদি হতাম, কুড়ি বছর পরে, শঙ্খমালা, নগ্ন নির্জন হাত, হাজার বছর শুধু খেলা করে, কুড়ি বছর পরে অন্ধকার স্বপ্নের ধ্বনিরা, শ্যামলি, তুমি — সহ কি অসাধারণ সব কবিতা।
এরপর আর কি লিখতে হয়। কি লেখার আছে!
বোধ কবিতা? লিখেছেন পরে। তবে বনলতাতেই সবচেয়ে গভীরবোধের বাস।
জীবনানন্দ দাশ পরে যা লিখেছেন আমি মনে করি তা বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সম্প্রসারিত রূপ বা দিক।
ঝরা পালক কিংবা ধূসর পান্ডুলিপি অথবা পরের মহাদেশ, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা,
বেলা অবেলা কালববেলা , এস্ত নীলিমা, একান্ন, আবছায়াসহ অন্যান্য গ্রন্থে ফুটে উঠেছে কবির বাংলা হতে মহাদেশ ঘুরে বাংলার জায়গান।
ব্রিটিশ কবি জো উইন্টার ও মার্কিন কবি ক্লিনটন বি সিলিসহ অনেক বিদেশি কবিতাটি অনুবাদ করেছেন।
ক্লিনটন বি সিলি তো জীবনানন্দ দাশ কে নিয়ে গবেষণাই করেছেন।
মনে জমা অনেক কথা,আক্ষেপও আছে। বাংলার মানুষই বাংলার কবিকে যথার্থ সম্মান দিতে পারিনি।
জোরেসোরে জীবনানন্দ দাশকে একজন দার্শনিক কবির উপাধিও দিতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্বকে জানাতে পারিনি আমাদের একজন জীবনবোধের দার্শনিক কবি আছে!
যা হোক রাগ-অভিমান থাকুক। শেষ করি—
আমি একটু জীবনানন্দ দাশের মত অসমাপ্ত করে রেখে শেষ করি —
হাজার বছর ধরে বাংলা হাঁটিতেছে জীবনানন্দ সেখানে উপস্থিত। জীবনানন্দ থাকলে সেখানে বেদনা,বিচ্ছেদ বা ট্রাজেডিও থাকবেই।
বাংলা।জীবন। আনন্দ।বেদনা।বিচ্ছেদ। প্রেম।অসীম।
সব মিলে জীবনানন্দ।একটা মানব ইতিহাস।মহাকাব্য।
– তুষার হাসান ( সম্পাদক : সাহিত্যপাতা পত্রিকা)