একটা সময় ছিল, যখন সন্ধে হলেই পরিবার একসঙ্গে বসত। কেউ গল্প বলত, কেউ বই পড়ত, কেউবা রেডিও বা টেলিভিশনের সামনে বসে সমাজ, সংস্কৃতি আর দেশের কথা ভাবত। এখনো সন্ধে নামে, বাতিগুলো জ্বলে ওঠে, কিন্তু চারপাশে এক ধরনের নিঃশব্দতা। মুখোমুখি নয়, মানুষ এখন ব্যস্ত মোবাইলের পর্দায়। যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে উঠেছে প্রত্যেক মানুষের মাঝখানে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনে এসেছে আশীর্বাদের মতো—প্রিয়জনকে কাছে এনে দিয়েছে, পৃথিবীর খবর হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছে, মত প্রকাশের এক মুক্ত মঞ্চ খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই আশীর্বাদটা যেন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক বিষাক্ত নেশায়, যা অজান্তেই গিলে ফেলছে আমাদের সময়, সম্পর্ক, মনন ও মূল্যবোধ।
চোখে পড়ে, এখন মানুষ কথা বলার আগেই ভাবছে—“এটা ভিডিও করে আপলোড দেওয়া যাবে কি না?”, “ভাইরাল হবে তো?”। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে মানুষ মোবাইল ক্যামেরা অন করে। আগে যেখানে হৃদয়ের ডাক ছিল, এখন সেখানে ক্লিকের প্রতিযোগিতা। একটা মৃত্যু, একটা কান্না, একটা অপমান—সবই হয়ে যাচ্ছে ‘কনটেন্ট’। যেন বাস্তবতা নয়, আমরা একটা ডিজিটাল নাটকে বাস করছি।
তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকালে দেখা যায়, একটা বিশাল অংশ দিন কাটাচ্ছে কীভাবে লাইকের সংখ্যা বাড়ানো যায়, কোন ট্রেন্ডে নাচলে ভাইরাল হওয়া যাবে, বা কোন ডায়লগ নকল করলে সবাই হাসবে। এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা গভীর শূন্যতা—আত্মপরিচয়ের। তারা ভুলে যাচ্ছে যে, একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ার চেয়ে বেশি জরুরি নয় কিছুই। অথচ এখন সাফল্যের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ফলোয়ার, ভিউ আর রিলস।
এই ডিজিটাল ব্যস্ততা শুধু তরুণদের নয়, প্রভাব ফেলছে ছোট শিশু থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠ সবার মধ্যেই। অভিভাবকেরা সন্তানকে সময় না দিয়ে, হাতে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল। ‘শান্ত থাকার জন্য এটা দরকার’—এই যুক্তিতে শিশু শিখছে মনোযোগের পরিবর্তে স্ক্রিনে ডুবে থাকা। তারা বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তব জগতের অনুভূতিগুলো।
অফিসেও দেখা যায়, একজন কর্মী হয়তো মনোযোগ দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছু পর পর ঢুকে পড়ছে বিজ্ঞাপন, মেসেজ, অথবা ভাইরাল কোনো নোটিফিকেশন। মনোযোগ ছিন্ন হয়, কাজের মান কমে যায়। আবার ঘরে ফিরে এসে মানুষ কথা বলে না, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সবচেয়ে কষ্টের বিষয়টি হলো—আমরা যেন ধীরে ধীরে অমানবিক হয়ে উঠছি। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে মানুষ, অথচ কেউ সাহায্যের জন্য ছুটে আসে না—কেবল ভিডিও তোলে। কেউ কাঁদছে, আর তার পাশে দাঁড়ানোর বদলে তার কান্না দিয়ে বানানো হয় কন্টেন্ট। এই মানুষগুলো একসময় অনুভব করবে, প্রযুক্তি আমাদের তথ্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে হৃদয়ের স্পন্দন।
আমাদের চারপাশে এখন এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে মানহীন কনটেন্টই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। শিক্ষামূলক, নৈতিক, শিল্পভিত্তিক কাজগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে এই তুফানগতি ভাইরাল হাওয়ার নিচে। কারণ মানুষ যা দেখে, সেটিই গ্রহণ করে। তাই যখন একজন অশালীন কনটেন্ট নির্মাতা লাখো লাইক পায়, তখন অন্যজনও উৎসাহিত হয় একই পথে হাঁটতে।
এই প্রেক্ষাপটে, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত—এই পথে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা কী ধরনের সমাজ রেখে যাচ্ছি? প্রযুক্তিকে কি আমরা সত্যিই সহযোগী হিসেবে নিচ্ছি, নাকি নিজেরাই হারিয়ে ফেলছি নিজেদের?
তবে এখনো সময় আছে। পরিবর্তনের শুরুটা হোক ব্যক্তি থেকে। আমরা নিজেরাই ঠিক করি কোন কনটেন্টে প্রতিক্রিয়া দেব, কোনটা এড়িয়ে যাব। আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করি—এই পোস্টটা কি সমাজকে ভালো বার্তা দিচ্ছে? আমাদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাই, ওদের বলি—‘ভাইরাল হওয়া বড় কথা নয়, মানুষ হওয়াটাই আসল’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা উচিত এমন পাঠ যেখানে শুধু সিলেবাস নয়, শেখানো হবে মূল্যবোধ, শেখানো হবে স্ক্রিনের ওপাশে একজন মানুষের অনুভব আছে। সরকার, গণমাধ্যম, পরিবার, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান—সবাই মিলে একটা স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল পরিবেশ গড়তে পারে। কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, দরকার অনুপ্রেরণা—ভালো কনটেন্টের, গঠনমূলক চিন্তার।
একটা সমাজ গড়ে ওঠে যখন মানুষ নিজের দায়িত্ব বোঝে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় সেই দায়িত্ব আজ অনেক বেশি জরুরি। কারণ সোশ্যাল মিডিয়া আর কেবল একটি অ্যাপ নয়, এটি আমাদের নতুন সভ্যতার আয়না। সেই আয়নায় আমরা কী দেখাতে চাই—সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।
ফাহিম হাসনাত
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।