তারিখ: ২০৪৫ সালের ৫ জুন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
সকাল থেকে শহরের বাতাসে একধরনের অদ্ভুত নির্জনতা। রাস্তায় কোলাহল নেই, নেই কোনো যানবাহনের গর্জন। শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের অপরাধে, নিজের করা পাপের ভারে।
বৃদ্ধ মানুষটি ধীর পায়ে হাঁটছেন, হাতে একটি ছোট ব্যাগ, তাতে একমাত্র বস্তু- একটা খালি প্লাস্টিক বোতল। বোতলটির গায়ে ধুলোর আস্তরণ, কিন্তু তার চোখে বোতলটির জন্য একরকম শ্রদ্ধা।
তার নাম আব্দুল্লাহ আল মামুন। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। চিৎকার করে বলতেন- “প্লাস্টিক আমাদের শেষ করে দেবে! প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, মাটির উর্বরতা শেষ হবে, জলজ প্রাণীরা বিলুপ্ত হবে।” কেউ কান দেয়নি।
বছরের পর বছর তিনি প্লাস্টিক বর্জনের কথা বলে গেছেন, কিন্তু মানুষ তখনও ‘সুন্দর’ প্যাকেজিংয়ের প্রেমে মজে ছিল।
বছর দশেক আগে শহরের সব নদী নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মাছ আর পাওয়া যেত না। শিশুরা এখন নদীকে শুধু বইয়ের পাতায় দেখে।
মামুন সাহেব হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালেন শহরের পুরোনো একটি সংগ্রহশালায় সেখানে তিনি বোতলটি জমা দেবেন।
এই বোতলটি শহরের শেষ প্লাস্টিক বোতল।
হ্যাঁ, সত্যি।
বছর তিনেক আগে সরকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে প্লাস্টিক। কঠোর নিয়ম, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নাগরিক সচেতনতায় ধীরে ধীরে সব প্লাস্টিক উঠে যায়। এখন সবাই কাগজ, মাটি, পাট বা ধাতব পাত্র ব্যবহার করে।
এই শেষ বোতলটিকে তিনি জমা দেবেন একটাই কারণে-
যেন মানুষ ভুলে না যায় সে দিনের ভয়াবহতা। যেন ভবিষ্যতের শিশু একদিন এসে জেনে নিতে পারে- “মানুষ একসময় এমন বস্তু ব্যবহার করত, যা প্রকৃতিকে হত্যা করত। আর একদিন তারা জেগে উঠেছিল, রক্ষা করেছিল এই পৃথিবীকে।”
বোতলটি এখন একটি কাঁচের বাক্সে রাখা। তার পাশে একটি ফলক: “এক বোতল, এক ইতিহাস-দেশকে ফিরিয়ে আনার গল্প।”
বাইরে তখন শুরু হয়েছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।
শিশুরা গাছ লাগাচ্ছে।
মামুন সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখে জল।
পেছনে পড়ে থাকে একটা পুরোনো প্ল্যাকার্ড-
“প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়।”
লেখা: ফাহিমা আক্তার।
শিক্ষার্থী: দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।