রিভিউ লেখক : রিপন আল মামুন।
বইয়ের নাম : মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা ‘স্বপ্ন’
লেখক : সিগমুন্ড ফ্রয়েড
বইয়ের ধরন : মনোবিজ্ঞান ( স্বপ্ন নিয়ে ব্যাখা মূলক বই)
প্রকাশনী : হাওলাদার প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ১৭৫
মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা ‘স্বপ্ন’ বাংলায় অনুদিত সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর বইটি মূলত তার স্বপ্ন সম্পর্কিত একটি বক্তৃতামালার বঙ্গানুবাদ। ফ্রয়েড এটি বক্তৃতা গুলো দান করেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৫ – ১৯১৭ সালের মধ্যে। সম্পূর্ণ বক্তৃতা মালার নাম ছিল : মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা। দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, মানসিক রোগ চিকিৎসক, মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। মনোসমীক্ষণ” (Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।
মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা ‘স্বপ্ন’ বইটির ভূমিকা হিসেবে সিগমুন্ড ফ্রয়েডেরই একটি স্বল্প বিস্তার লেখা দেওয়া হয়েছে। এখানে ফ্রয়েড বর্ণনা করেছেন মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে অল্প কিছু ধারণা। ফ্রয়েডের মতে মনঃসমীক্ষণ প্রথমেই শিখতে হয় নিজের সম্পর্কে, অর্থাৎ নিজের ব্যক্তিত্বকে বিশদভাবে অনুশীলন করার মধ্য দিয়ে এই শেখা শুরু হয়। ফ্রয়েড এখানে মনঃসমীক্ষণের দুটি প্রধান সূত্রের কথা বলেছেন। প্রথম সূত্রটি হচ্ছে : মানসিক প্রক্রিয়াগুলো অবশ্যই অচেতন ( নির্জ্ঞান) আর যেসব প্রক্রিয়ার সচেতন, তারা কিছু বিচ্ছিন্ন কার্যকলাপ মাত্র এবং গোটা মানসিক সত্তার নেহাতই একটা অংশ। মনো সমীক্ষণের দ্বিতীয় সূত্রটি হচ্ছে: স্নায়ুরোগ এবং মানসিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সংকীর্ণ এবং ব্যাপক এই দুই অর্থেই আমাদের যৌন আবেগের বিশাল বিস্ময়কর ভূমিকা আছে।

ফ্রয়েডের এই অনুদিত বক্তৃতামালায় মনঃসমীক্ষণ ও এর সাথে গভীর সম্পর্কিত স্বপ্ন ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। স্বপ্ন কী, স্বপ্নের সাথে ঘুমের সম্পর্ক, স্বপ্ন উপাদান, স্বপ্ন সেন্সর ব্যবস্থা, স্বপ্ন প্রতিক ব্যবস্থা, স্বপ্ন ক্রিয়া, স্বপ্নের পৌরাণিক এবং শৈশব উপাদান, স্বপ্ন বিশ্লেষণ সহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এই বক্তৃতাগুলোয়।
স্বপ্ন হচ্ছে মনঃসমীক্ষণ গবেষণারই একটি বিষয়বস্তু। ফ্রয়েড এখানে এরিস্টটলের স্বপ্নের ব্যাখ্যাটি তুলে ধরে বলেছেন, “ঘুমের অভ্যন্তরীণ মানসিক জীবন হচ্ছে স্বপ্ন, যারা জাগ্রত জীবনের সঙ্গে যেমন কিছু মিল আছে, তেমনি পার্থক্য আছে প্রচুর।”। স্বপ্ন আর স্বপ্নের ব্যখা সম্পর্কে ফ্রয়েড বলেন, ” স্বপ্ন হচ্ছে নিজ্ঞান কোনো কিছুর বিকৃত পরিবর্ত বা বদলি, আর স্বপ্ন-ব্যাখ্যা হচ্ছে ঐ নিশ্চেতন বা চেতনা-বহির্ভূত নির্জ্ঞান চিন্তাকে আবিষ্কার করা। স্বপ্ন যে কোন ইচ্ছা থেকে তৈরি হয়, আর স্বপ্নের বিষয়বস্তু যে ঐ ইচ্ছাটিকেই প্রকাশ করে এটাই হচ্ছে স্বপ্নের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বপ্নের দ্বিতীয় আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা ঐ ইচ্ছাকে শুধু প্রকাশ করে তা-ই নয়, ঐ ইচ্ছাপূরণ সম্পন্ন করে একটি কল্পবিভ্রমকারী অভিজ্ঞতায় (hallucinatory experience)।

স্বপ্ন মূলত অবচেতন মনে লুকানো চিন্তা, ইচ্ছা, ভয় ও দমিত কামনার প্রকাশ। কিন্তু এই উপাদানগুলো সরাসরি নয়, বরং প্রতীকী ও বিকৃত আকারে প্রকাশ পায়। ফ্রয়েড দুই ধরনের স্বপ্ন বস্তুর কথা বলেছেন – গোপন স্বপ্নবস্তু (Latent Dream Content) ও প্রকাশ্য স্বপ্নবস্তু (Manifest Dream Content)।
অর্থাৎ, “স্বপ্ন উপাদান” বলতে বোঝায় স্বপ্নের এই দুই স্তর—গোপন ও প্রকাশ্য অংশ—যার মাধ্যমে অবচেতন মানসিক উপাদান প্রতিফলিত হয়।
ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মানসিক গঠনে একটি “সেন্সর” বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করে, যা স্বপ্নের প্রকৃত বিষয়বস্তু সরাসরি প্রকাশ হতে বাধা দেয়। সেন্সর হলো এক ধরনের মানসিক প্রহরী, যা অবচেতন (Unconscious) ও চেতন (Conscious) মনের মাঝে অবস্থান করে। যখন দমিত চিন্তা বা কামনা ঘুমের সময় অবচেতন থেকে উপরে উঠতে চায়, তখন সেন্সর সেটাকে বিকৃত করে, যাতে তা গ্রহণযোগ্য আকারে প্রকাশ পায়। ফলে আমরা স্বপ্নে যে দৃশ্য দেখি তা আসলে বাস্তব ইচ্ছার বিকৃত প্রতীকী রূপ।

অপর দিকে ফ্রয়েডর মতে, স্বপ্ন প্রতিক ব্যবস্থা” হলো সেই মানসিক প্রক্রিয়া যা অবচেতন ভাবনাকে বিকৃত, প্রতীকী ও গ্রহণযোগ্য আকারে প্রকাশ করে। সাধারণত মানব মনে এমন কিছু ইচ্ছে লুকায়িত থাকে যা প্রকাশ পেলে ব্যক্তি নিজেই অস্বস্তি বা লজ্জিত হবে। ফ্রয়েড উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, যখনই কেউ আমাদের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ান, তিনি বাপ-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী যেই হোক না কেন, (যা প্রায়শই ঘটে যেহেতু আমাদের সম্পর্কগুলি অত্যন্ত জটিল) তখনই তাদের পথের কাঁটা হিসেবে সরিয়ে ফেলার জন্য একটি স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক। আর তখন বিকৃত কোন প্রতিক বা সিমবলের সাহায্যে সেটা স্বপ্নে প্রকাশিত হয়।
ফ্রয়েড স্বপ্ন নিয়ে এখানে শুধু বর্ণনাই করেননি তার রোগীদের বিভিন্ন স্বপ্ন ব্যাখাও তুলে ধরেছে। বিভিন্ন সময় রোগীরা তার কাছে বিভিন্ন স্বপ্নের কথা বলতো। আর ফ্রয়েড সেই স্বপ্ন গুলোর ব্যাখা দেওয়ার জন্য এতোটাই উদগ্রীব আর মনোযোগী থাকতো যে, ফ্রয়েড নিজেই এখানে উল্লেখ করেছেন একবার তিনি তার এক রোগীর স্বপ্নের ব্যাখা ভাবতে ভাবতে রাস্তা থেকে ছিটকে রাস্তার বাইরেই পড়ে যান।
বইটি থেকে ফ্রয়েডের কিছু উক্তি কোট করছি।
★ মনঃসমীক্ষণ প্রথমেই শিখতে হয় নিজের সম্পর্কে, অর্থাৎ নিজের ব্যক্তিত্বকে বিশদভাবে অনুশীলন করার মধ্য দিয়ে এই শেখা শুরু হয়।
★ মানব চরিত্রের একটি ঝোঁক হচ্ছে যা কিছু অপ্রিয় তাকে অসত্য বলে ভাবা এবং সহজেই তার বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করা।
★ খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ব্যক্তি তাদের জীবনের যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রেরণা পেয়েছেন স্বপ্ন থেকে।
★ স্বপ্ন হচ্ছে নিজ্ঞান কোনো কিছুর বিকৃত পরিবর্ত বা বদলি, আর স্বপ্ন-ব্যাখ্যা হচ্ছে ঐ নিশ্চেতন বা চেতনা-বহির্ভূত নির্জ্ঞান চিন্তাকে আবিষ্কার করা।
★ স্বপ্নের সাহায্য ছাড়া আমরা ঘুমোতেই পারতাম না। আমরা যেটুকু ভালোভাবে ঘুমোই, সেটুকু স্বপ্নের জন্যই সম্ভব, আমাদের ভালো ঘুমের জন্য আমরা স্বপ্নের কাছেই ঋণী।
রিভিউ লেখক : রিপন আল মামুন, শিক্ষার্থী : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।