আজকের পৃথিবী যেন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্কের বাঁধনে বাঁধা। সকালে ঘুম ভাঙতেই আমরা প্রথম দেখি ফোনের স্ক্রিন, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও শেষ স্পর্শ সেই পর্দায়। জানি না কবে শেষবার প্রকৃত সূর্যোদয়ের রঙটা মন দিয়ে দেখেছিলাম। ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের জীবনে এনে দিয়েছে সুবিধা, সংযোগ, বিনোদন—কিন্তু এর আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক মায়াবী ফাঁদ। সোশ্যাল মিডিয়া, গেমস, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স—এ যেন আমাদের নতুন জগৎ, যেখানে আমরা হাসি, কান্না করি, ভালোবাসি, এমনকি ঘৃণাও ছড়িয়ে দিই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকেই দেখি, কে কী করলো, কার কী নতুন ছবি, কে কোথায় ঘুরতে গেল। অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা—অন্যের জীবনের দিকে তাকিয়ে নিজেরটা মাপার চেষ্টা। যেন নিজের উপস্থিতিটা এখন লাইক আর কমেন্টের পরিমাণে পরিণত হয়েছে।
এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবাই পারফেক্ট, ফিল্টার করা হাসি, সাজানো সুখ—আর আমরা, বাস্তব জীবনের ক্লান্ত মুখগুলো, তা দেখে নিজেদের নিয়ে হতাশ হই। একেকজন যেন নিজেদের জীবন নিয়ে ভুল বোঝায় ভোগা আত্মা—দুঃখ চেপে রেখে সুখের পোস্ট দিই। এই আসক্তি কেবল প্রযুক্তিতে নয়, আমাদের একাকীত্ব, অনিশ্চয়তা, আত্মপরিচয়ের সংকটেও। প্রশ্ন ওঠে, এ জগৎ থেকে আদৌ কি মুক্তি সম্ভব? নাকি আমরা ধীরে ধীরে বাস্তবতার জগতকেই হারিয়ে ফেলছি?
এই ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের দিয়েছে অসীম সুযোগ। দূরের মানুষ হয়ে উঠেছে কাছে, অজানাকে জানতে পারছি চোখের পলকে, তথ্য ও বিনোদন যেন হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেই সঙ্গে এসেছে এক ভয়ংকর আসক্তি, যেটা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাদের মানসিক শান্তি, সম্পর্ক, এমনকি আত্মপরিচয়কেও। প্রযুক্তি নিজে ক্ষতিকর নয়, বরং তার ব্যবহারই নির্ধারণ করে ফলাফল। কিন্তু সমস্যার শুরু তখনই, যখন ব্যবহার থেকে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। গড়পড়তা মানুষ দিনে ৭–৮ ঘণ্টা মোবাইল ফোনে সময় কাটায়—তা কাজ হোক বা বিনোদন। অনেকেই দিনশেষে স্বীকার করেন, এই সময়টা তাদের জীবনে তেমন কিছুই যোগ করেনি।
ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ একটা নীরব অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একধরনের ‘ডিজিটাল ডোপামিন’ আমাদের মস্তিষ্কে এমনভাবে কাজ করছে যে আমরা বারবার ফোন তুলতে বাধ্য হচ্ছি, নোটিফিকেশন না দেখলে অস্থির লাগছে, অফলাইন হলে মনে হচ্ছে জীবনের কিছু একটা মিস হয়ে যাচ্ছে। এই আসক্তি কেবল সময় নষ্ট করছে না, বরং আমাদের বাস্তব জীবন থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। পরিবারে একসাথে বসে খাওয়ার সময়ও সবাই নিজেদের স্ক্রিনে ডুবে, বন্ধুরা দেখা করেও গল্পের বদলে রিলস স্ক্রল করে। আমরা হয়তো অনেক “অনলাইন বন্ধু” পেয়েছি, কিন্তু হারিয়েছি গভীর সম্পর্কের অনুভব, চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস। এখন চোখে চোখ রাখা কঠিন হয়ে গেছে। আমরা সাহস হারিয়ে ফেলেছি—আসল অনুভূতির মুখোমুখি হতে। স্ক্রিনে তাকানো সহজ, কিন্তু কারো চোখে নিজের ছায়া খোঁজা ভয়ংকর কঠিন।
অনেকেই নিজেদের জীবনের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছে। মানসিক চাপ, হতাশা, একাকীত্ব বেড়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের চারপাশে কেউ টেরও পাচ্ছে না। তাহলে মুক্তি কোথায়?
আমি জানি, প্রযুক্তি খারাপ না। কিন্তু এই ভালো জিনিসটাই যখন চোখ বেঁধে ফেলে, তখন সেটাই ভয়ানক হয়ে ওঠে। এখন পরিবারে সবাই একসঙ্গে থাকলেও, প্রতিটি মানুষ যেন আলাদা দ্বীপ—প্রতিটা মাথা নিচু, স্ক্রিনে ডুবে। কথার বদলে ইমোজি, চোখের ভাষার বদলে টাইপিং… আমরা ধীরে ধীরে দূরত্বের মাঝে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আগে যেখানে ছিল আড্ডা, গল্প, চা—সেখানে এখন শুধু মোবাইল স্ক্রল। আমরা বসে আছি, কিন্তু ‘একসাথে’ নেই।
আমি নিজেই অনেকবার ফোন হাতে নিয়ে সময় নষ্ট করেছি, অথচ করণীয় কাজগুলো পড়ে থেকেছে। নিজের সঙ্গে একটা অব্যক্ত লড়াই চলে—আমি কি আসলেই এতটাই দুর্বল, যে একটা স্ক্রিন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? একদিন হয়তো আমরা নিজের কাছে উত্তর চাইব—যে সময়গুলো বিনা কারণে স্ক্রিনে হারিয়ে গেল, তার বদলে আমরা কী পেলাম? তখন মনে হবে, জীবনের আসল জিনিসগুলো খুব কাছেই ছিল—শুধু আমরা মুখ ফিরিয়ে ছিলাম।
তবু এই দুনিয়াকে অস্বীকার করা যাবে না। এটা আমাদের জীবনের অংশ, সেটা মানতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো—কে কাকে চালাচ্ছে? প্রযুক্তি আমাকে চালাচ্ছে, নাকি আমি প্রযুক্তিকে?
ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে, এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যদি এই জগৎই আমাদের নিজেদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তবে তা নিঃসন্দেহে এক বিপর্যয়। আসক্তির চক্র থেকে বেরিয়ে এসে ভারসাম্য তৈরি করাই আমাদের মুক্তির পথ। ভার্চুয়াল পৃথিবী থাকবে, প্রযুক্তিও থাকবে, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের চাওয়া হওয়া উচিত—প্রযুক্তি যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ না করে, বরং আমরা যেন প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করি। নিজেদের হাতে নিয়ন্ত্রণ রাখাটা এখন আগের চেয়েও বেশি জরুরি।
আমরা কি পারবো এই ডিজিটাল আসক্তির বাঁধন ছিঁড়ে বাস্তবের কাছে ফিরতে?
তাসমিয়া রশিদ মালা
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।