দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কলেজগুলোতে অবহেলিত এবং দারুণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বিষয়টি। ঠিক যেন নিজ গৃহে পরবাসী বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পাঠদানকে কেন্দ্র করে গঠিত ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চরমভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। একটি জাতির আত্মপরিচয় গঠনে যে বিষয়টি অপরিহার্য, সেই বিষয়টির এমন অবহেলা।
অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বিষয়টিকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েই পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে তিনটি ধারা থাকবে সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারা এবং প্রত্যেক ধারা কয়েকটি শাখায় বিভক্ত থাকবে। সব ধারাতেই জন-সমতাভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে যথা- বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক থাকবে। এছাড়াও শিক্ষানীতির অন্যতম একটি সুপারিশ ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সকল বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের (মাউশি) অধীনে। সুতরাং মাউশি’র রেজিস্ট্রেশন করতে হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন দেশের সিলেবাসের আলোকে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে।
এর বাস্তবায়নের পিছনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অবিভাবকরা বেশি দায়ী। অনেক অভিভাবকই চান না তাদের সন্তান বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়ুক। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অভিজাত ও ধনাট্য ব্যক্তির সন্তানরা যেহেতু বাইরের দেশেই পড়তে যান। তাই অভিভাবকরা মনে করেন বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়ে খুব বেশি লাভ নেই। এছাড়াও যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব সিলেবাস পড়ানো হয় তারা বেসরকারি বিভিন্ন বই পড়ান।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি দিয়ে। পরবর্তীতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’-এর সুপারিশের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন ২০১৩-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এমনকি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সুপারিশে শিক্ষানীতি কার্যকর হওয়ার এক মাসের মধ্যে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। পরবর্তী সময়ে আবার ‘শিক্ষা আইন ২০১৪’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেটিও আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তবে বিদ্যমান ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ অনুযায়ী যেসব শিক্ষা কার্যক্রম তথা পাঠ্যক্রম গ্রহণ বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য হওয়া সত্ত্বেও কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা নিয়ে সচেতন মহলে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
এই বিষয়টি শুধু শিক্ষানীতির ব্যর্থতাই নয়, এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও মূল্যবোধের সংকট হিসেবেও বিবেচ্য। জাতীয় শিক্ষানীতির যে মৌলিক উদ্দেশ্য দেশ প্রেমিক নাগরিব গড়ে তোলা, এটি অর্জনের পথে বাধাঁ সৃষ্টি করছে বিদেশি মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়টি। এর ফলে ঘটছে হলি আর্টিজেনের মতো অমানবিক ঘটনা। হলি আর্টিজনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছিলেন, তাদের সবাই ছিল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অন্তত ২ জন ছিলেন স্কলাস্টিকা’র পড়াশুনা করা। শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, দেশের ইতিহাস, সংগ্রাম, জাতিসত্তার মূল্যবোধ থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীরা কখনো কখনো সহজেই বিভ্রান্ত মতাদর্শের শিকার হতে পারে। দেশপ্রেম ও নিজের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে না জানলে ও শ্রদ্ধাশীল না হলে সহজেই সে মানুষটির দ্বারা যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০২২-এর ৫০(১) ধারায় ‘ইংরেজি মাধ্যম বা বিদেশি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত সাধারণ শিক্ষার সকল ধারায় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা। আইনে ইংরেজি মাধ্যমের বা বিদেশি পাঠ্যক্রমের শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
কাজেই ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০’-এর আলোকে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০২২-এর যেসব পাঠ্যক্রম বাধ্যতামূলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’। সাধারণত একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যথাযথ জ্ঞান অর্জনের জন্যই এ ধরনের পাঠ্য অন্তর্ভুক্তের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রেই তাদের নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে এ ধরনের পাঠ্য বাধ্যতামূলকভাবে চালু রয়েছে। যেমন: যুক্তরাষ্ট্রে ‘American History’, ভারতে ‘Indian History and Civics’, ফ্রান্সে ‘French Civilization’—এসব বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে। অথচ বাংলাদেশে নিজেদের ইতিহাসভিত্তিক বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে নিজের দেশেই।
তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর সমাধান কোথায়। বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি শিক্ষার মূলস্রোতে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের জোরালো নীতিমালা বাস্তবায়ন, নিবন্ধন বাতিলসহ কার্যকর পদক্ষেপ এবং অভিভাবক-শিক্ষকের মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ছাড়া এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ পাঠ্যকে সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।
রিপন আল মামুন
শিক্ষার্থী : মনোবিজ্ঞান বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।