বিহারের শাসনকর্তা লর্ড সিংহ বাহাদুর ভয়ানক মুশকিলে পড়িয়া গিয়াছেন। ঠিক যেন সাপের ছুঁচো গেলা গোছ। ছাড়িতেও পারেন না, গিলিতেও পারেন না। সহযোগিতাবর্জন আন্দোলন বিহারে যে রকম জোরে চলিতেছে, সেরূপ আর কোথাও নয়। মহাত্মা গান্ধিও এই লইয়া সেদিন ‘ইয়ং ইণ্ডিয়ায়’ বিহারের জোর প্রশংসা করিয়াছেন। এই ব্যাপারে বিহার গভর্নমেন্ট দস্তুর মতো বে-সামাল হইয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা ইহার ছোট শাসন-কর্তারা রাগের বা ভয়ের চোটে যখন তখন যা-তা করিয়া বসিতেছেন। সেদিন পুরুলিয়ার ডেপুটি কমিশনার উকিলদিগকে ধমকাইতে গিয়া অপ্রতিভের এক-শেষ হইয়াছেন। তারপর মহকুমায়-মহকুমায়, জেলায়-জেলায় ম্যাজিস্ট্রেটগণ যে রকম সৃষ্টিছাড়া হুকুম জারি করিতেছেন, তাহা দেখিয়া বুঝা যায় যে, বাস্তবিকই এবার তাঁহারা চটিয়াছেন। মদের উপকারিতা লইয়া যে সরকারি ইস্তাহার জারি হইয়াছিল, তাহার কেলেঙ্কারি আর বলিলাম না। লর্ড সিংহ বাহাদুর বড় অসময়ে লাট ও শাসনকর্তা হইয়াছেন। এখন তিনি দেশের লোকের মন যোগাইয়া চলিতে পারেন না, আবার তাঁহার অধীন বিলিতি শাসনকর্তাদিগকেও জোর করিয়া কিছু বলিতে পারেন না, পাছে তাঁহারা তাঁহার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করিয়া বসেন। দেশের লোক এখন যাহা চায়, তাহাও যদি আবার তিনি বিনা বাধায় চলিতে দেন, তাহা হইলে তো আবার তাঁহাকে একদিনেই পাততাড়ি গুটাইতে হয়।
আর তাহা ছাড়া দেশের লোকের বর্তমান দাবি-দাওয়া পূর্ণ করাও তাঁহার ক্ষমতার বাহিরে। একটা প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে আমরা যতটা স্বাধীন মনে করি, আসলে তিনি ততটা স্বাধীন নন। তিনিও প্রকারান্তরে শুধু তাঁহার উপরওয়ালারই হুকুম তামিল করেন, বলা যাইতে পারে। কাজেই বুঝিয়া হউক, না বুঝিয়া হউক, দেশের লোকে তাঁহার উপর বিষম চটিয়া উঠিতেছে এবং নানান রকমের টীকাটিপ্পনীও কাটিতেছে। এ-হুলের বিষ-জ্বালা তাঁহাকে অতি কষ্টে নীরবেই সহ্য করিতে হইতেছে। কেননা আমরা ছেলেবেলায় পদ্য পাঠে পড়িয়াছি, ‘অসহ্য জাতির বাক্য সহ্য নাহি হয়, সাপের মাথায় যেন ব্যাঙে প্রহারয়।’ কিন্তু ইহাতে তাঁহার দুঃখ-কষ্ট অনুভব করা উচিত নয়। কেননা সর্বপ্রথম দেশীয় শাসনকর্তা বলিয়া দেশের লোক তাঁহার নিকট অনেক কিছু আশা করিয়াছিল। কিন্তু কর্মের বা গ্রহের ফেরে সমস্ত ওলট-পালট হইয়া গেল। এখন তিনি দেশের লোককে সন্তুষ্টও করিতে পারেন না এবং খুব কষিয়া কড়া শাসন চালাইয়া তাহাদিগের মুখবন্ধ বা তাহাদের দোরস্ত করিতেও পারেন না। কেননা বেশি জোর-জবরদন্তি করিলে দেশের লোক আরো বেশি ক্ষেপিয়া উঠিবে। মানুষের চামড়া কিন্তু গণ্ডারের চামড়া নয়, অতএব দেশ-ভাই-এর এ-আঘাত হয়তো তাঁহার গায়ে দারুণ বাজিবে। আজ যদি বিহারের শাসনকর্তা কোনো ইংরেজ হইতেন, তাহা হইলে হয়তো দেশবাসী বিহার লইয়া এত বেশি আলোচনা করিত না। অথবা তিনি যে-প্রদেশেরই লাট হইতেন, সেই প্রদেশের শাসন ইত্যাদি ব্যাপারে দেশের লোক বেশি করিয়া চোখ রাখিত। দেশীয় শাসনকর্তার নিকট দেশ-ভাই-এর একটু বেশি অধিকারের দাবি বাড়াবাড়ি বোধ হইলেও অন্তত অন্যায় নয়।
এ তো গেল এদিককার কথা। অন্য পিঠ-অর্থাৎ তাঁহার অধীন ইংরেজ শাসনকর্তারা যত বেশি প্রভুভক্তি ও কর্মকুশলতাই দেখান না কেন, এদেশী ‘নেটিভ’ শাসনকর্তার অধীন হইয়া থাকিতে তাঁহাদের মর্মস্থলে বেশ একটু বাজে এবং হিংসাও হয়। ইউরোপীয় গভর্নর থাকিলে তাঁহারা (বিশেষ করিয়া বিহার প্রদেশ বলিয়া) অনায়াসে দেশী লোককে নেটিভ, নিগার ইত্যাদি বলিয়া এ-গোলমালে খুব একচোট গালি-গালাজ করিয়া গায়ের ঝাল আর রসনার চুলকানি মিটাইতেন। কিন্তু এখন আর ও-রকম গালি-গালাজ দিতে পারিবেন না, কেননা তাহা হইলে প্রকারান্তরে লর্ড সিংহকেই গাল দেওয়া হইবে। অথচ তাঁহারা এটুকুও বুঝিয়াছেন যে, ইউরোপীয় শাসনকর্তার আমল অপেক্ষা তাঁহারা অধিকতর স্বাধীনভাবে এখন দেশকে শাসাইতে পারিবেন। কেননা, যতই হোক দেশীয় গভর্নর তো! তিনি কিছুতেই ইহাদের এই নীতিকে একদম বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন না। কেননা তখন এই ইউরোপীয় ‘ডিমিনিউটিভ’ শাসনকর্তারা দল বাঁধিয়া ইহার বিরুদ্ধে হৈ রৈ মার লাগাইয়া উপরওয়ালার কানে ঝালাপালা লাগাইয়া দিবে। এই সব এবং এই রকম আরো নানান গতিকে লর্ড সিংহ বাহাদুর চুপ করিয়া ভাবিতেছেন, ‘শ্যাম রাখি কি কুল রাখি!’ তিনি এখনো প্রাণপণে দু’ নৌকায় পা দিয়া আছেন বলিলেই হয়। কেননা, এখন তিনি হতাশ হইয়া বলিতেছেন, প্রকারান্তরে আমি গান্ধিজিকে সমর্থন করিতেছি। তাঁহার মতো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই আমার কাজ।
কিন্তু অবস্থা ক্রমেই যে রকম বিগড়াইয়া যাইতেছে, তাহাতে তাঁহার আর এ ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ ভাব চলিবে না।
আমরা তাঁহাকে আক্রমণ করিতেছি না, বরং তাঁহার এ-ত্রিশঙ্কুর মতো অবস্থা দেখিয়া সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি। দোষ তাঁহারও নয়, আমাদেরও নয়, এ-দোষ বুরোক্রাসির বা স্বেচ্ছাতন্ত্রের।
যতক্ষণ দেশের আদত শাসনকর্তা স্বেচ্ছাতান্ত্রিক, যতক্ষণ দেশ পরাধীন থাকে, ততক্ষণ দেশীয় ছোটখাট শাসনকর্তারা কিছুতেই লোককে সন্তুষ্ট করিতে পারেন না। আজ যদি লর্ড সিংহ ভারতের বড়লাটও হন, তাহা হইলেও তিনি দেশের জন্য তেমন কিছু করিতে পারিবেন না। তাঁহাকে অধিকাংশ সময়েই তাঁহার বিবেক-বিরুদ্ধ কার্য করিতে হইবে। দেশীয় লোক যত বড় পদই পান, তবু তিনি যে দেশীয় বা ‘নেটিভ’ একথা ইংরেজ কর্তারাও ভুলিবেন না, আর তিনি নিজেও ভুলিতে পারিবেন না। আজ যদি লর্ড সিংহ একটু দেশের লোকের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন, তাহা হইলেই সকলে বুঝিতে পারিবেন, ইংরেজ মন্ত্রীর দল কি রকম আপিস-তাপিস করিয়া উঠেন। তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইবেন-‘এক যাত্রায় পৃথক ফল!’ এ-দোষ কাহারও নয় ভাই-দোষ আমাদের এই কালো চামড়ার!
সংগ্রহ: নজরুলসমগ্র-১৩ (প্রবন্ধ)